সহজ রাখুন বিক্রি প্রক্রিয়া

sell

(এক)
আমার বাসায় গেস্ট আসবে। ওরা মিষ্টি খুব পছন্দ করে। বাসার কাছেই দুটো মিষ্টির দোকান। আমি গেলাম মিষ্টি কিনতে। একটা মিষ্টির দোকান সামনে পড়লো। কিন্তু দোকানটার নিয়ম হচ্ছে জুতা খুলে ঢুকতে হবে। অর্থাৎ ঐ দোকানের মিষ্টি কিনতে হলে আমাকে কেডস খুলতে হবে। ভিতরে ঢুকতে হবে। মিষ্টি কিনে, সেই মিষ্টির প্যাকেট নীচে রেখে, নীচে ঝুকে কেডসের ফিতা বাধতে হবে। এরপর মিষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। ক্যান বাপ? এত ঠেকলাম কিসের জন্য, তোর দোকান কি বরিশালের বিখ্যাত “ঘরভারানি মিষ্টান্নভান্ডার” যে এত আজাব করে তোর মিষ্টি কিনতে হবে? আমি কি করলাম কাছের অন্য একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম, যেখানে সবাই জুতা পড়ে ঢুকছে। সেখান থেকে রসগোল্লা, চমচম, ছানা কিনলাম। বাসায় এলাম। মিষ্টিগুলো ভালো ছিলো।

বিক্রি বাড়াতে সহজ রাখুন বিক্রি প্রক্রিয়া।
বিক্রি প্রক্রিয়া যদি জটিল হয়, কিছু মানুষ কিনবে। কষ্ট স্বীকার করে হলেও কিনবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্রেতাই একটু বেশি দাম দিয়ে হলেও আপনাকে ছেড়ে যাবে তাদের কাছে, যার বিক্রি প্রক্রিয়া সহজ।
যেমন অনেক দোকানদারকে দেখবেন, বিক্রি প্রক্রিয়া সহজ করতে দোকানে অনেক ভাংতি রাখে। ক্রেতা দুই কেজি আটা নেবে, তার কাছে ৫০০ টাকার নোট। এই মিনিমাম ৫০০ টাকার নোটও যদি ভাংতি না পায়। তাহলে ক্রেতা চলে যাবে পাশের দোকানে।
দোকানে চক্ষুলজ্জার কারণে অথবা পরিচিত দোকানদার হবার কারনে হয়তো ক্রেতা পাশের দোকানে নাও যেতে পারে, আপনি ৫০০ টাকা রাখেন, পরে বাকি টাকা নেবো, অথবা বাকিতে নিচ্ছি পরে দিয়ে দেবো।
কিন্তু অনলাইনে একজন ক্রেতা এত ছাড় দেবেনা। অনলাইনের প্রসঙ্গের আগে সেবা প্রকাশনীর উদাহরণ দিচ্ছি। সেবা প্রকাশনীর সেলস সিস্টেম এত সুন্দর। সহজেই যেকেউ সেবা প্রকাশনীর বই কিনতে পারতো এখনও পারে। সেবা প্রকাশনীর বই বিভিন্ন পত্রপত্রিকার দোকানে পাওয়া যায়। আমি ২০১৮ সালে ঈশ্বরদী গিয়েছিলাম। সেবা প্রকাশনীর একটা বই কেনার আগ্রহ দেখালাম। ঈশ্বরদীর রেলস্টেশনের একটা স্টলে বইটা পেয়ে গেলাম। ট্রেনে চড়ে রাজশাহী যেতে যেতেই বইটা পড়লাম। সেবা প্রকাশনী ক্রেতা হিসেবে আমাকে না হারানোর কারণ, তাদের বিক্রয় সিস্টেম অথবা চ্যানেল সহজ ছিলো।

(দুই)
অনলাইনে যদি ক্রেতা একবার টের পায় বিক্রি প্রক্রিয়া জটিল, সে চক্ষুবন্ধ করে অন্য অনলাইন শপে ভিজিট করবে।
অনলাইনে আপনার শপে ঢুকেই যদি টের পায়, কিনতে হলে মাস্টারকার্ড লাগবে, পেপাল লাগবে। যার এসব নেই, সে এসব দেখে ঘাবড়ে দৌড় দিয়ে ভাগবে।
পেমেন্ট প্রক্রিয়ায় আপনাকে ক্রেতাকে আশ্বস্ত করতে হবে আপনি বিকাশে পে করতে পারেন, নগদে পে করতে পারেন। চাইলে মাস্টারকার্ডেও পে করতে পারেন। ওসব থাকলে ভালো, আর ওসব এমনকি বিকাশ না থাকলে আরও ভালো। আপনি ক্যাশ অন ডেলিভারিতেও নিতে পারেন, হাতে জিনিস পেয়ে টাকা দেবেন, কত্ত সহজ।
আমাদের যাদের ই-কমার্স ওয়েবসাইট আছে। আমরা জানি, ই-কমার্স সাইটে অর্ডার প্লেস করতে হলে, ক্রেতার একাউন্ট থেকে লগিন করতে হয়। এরপরে Add to Cart এ নিয়ে, Checkout এরপর পেমেন্ট করতে হয়। আমরা অর্ডারটিকে এপ্রুভ করে পাঠিয়ে দেই।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ, গৃহিণীর কাছে এটা আজাব মনে হয়। এমনকি উচ্চশিক্ষিত অনেকেই এই প্রসেসে যেতে চাননা। আমি একজন উচ্চশিক্ষিত প্রফেসরকে চিনি, যিনি আজ পর্যন্ত ই-কমার্স সাইটে অর্ডার দেননি। অর্ডার দিয়েছেন ফেসবুক পেইজে। মেসেঞ্জারের মাধ্যমে। উনি এভাবেই কেনাকাটা করেন।
আমাদের যাদেরই ওয়েবসাইট আছে, তারা সাধারণত মোবাইলের Woo Commerce এপ্সটাকে ওয়েবসাইটের সাথে কানেক্ট করাই। মাঝেমধ্যে সেটা চেক করি। কিন্তু Woo Commerce এর চেয়ে আপনাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ফেসবুক পেজের মেসেজকে এবং আপনার বিজনেস হোয়াটসঅ্যাপকে। কারণ নক ওখান থেকেই আসে। মেসেঞ্জারে কেউ কেনাকাটা করতে চাইলে তাকে ওয়েবসাইটে নেয়ার জন্য অতটা চাপ দেয়ার দরকার নেই। একটু কষ্ট করে মেসেঞ্জার অথবা হোয়াটসঅ্যাপে তথ্য নিয়ে অর্ডার নিন। (যদি মনে হয় ফেক আইডি সেক্ষেত্রে বিনয়ের সাথে কৌশলে ফোন করতে বলুন।)
যেমন Time 2025 ওয়েবসাইটে নিয়মিত। কিন্তু তাদের ৭৫% সম্ভাব্য অডিয়েন্স যোগাযোগ করে ফেসবুকে। সেখানেই অর্ডার দেয়। তাদের ওয়েবসাইট ফর্ম থাকলেও, তারা গুগল ফর্মের লিংকই প্রেফার করে, যাতে অপরপক্ষের সুবিধা হয়।

(তিন)
সেল প্রসেস সহজ করার জন্য ওয়েবসাইটের চেয়ে ফেসবুক পেইজের গুরুত্ব হয়তো বুঝেছেন। কিন্তু তাইবলে ওয়েবসাইটকে অবহেলা করতে বলছিনা। ওয়েবসাইটে অর্ডারের হার দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। মানুষ সাহস করে ওয়েবসাইটে অর্ডার প্লেসে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আপনি দারাজ পিক-আপ পয়েন্টে যান। দিনকে দিন ভীড় কিন্তু ওদের বেড়েই যাচ্ছে। পিক-আপ পয়েন্টে তারাই যাচ্ছে, যারা অগ্রীম পেমেন্ট করে অর্ডার করে।
ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা এবং কেনাকাটা করা যেন সহজ হয় ক্লাইন্টের জন্য সহজ হয়, সেটাও খুব গুরুত্বের সাথে খেয়াল রাখতে হবে।
এখানে কয়েকটি পয়েন্ট দিচ্ছি। যা আপনি যতটা মনে রাখবেন ততই ভালো।
• ডোমেইন নামটা যেন সহজ এবং প্রাসঙ্গিক হয়। অর্থাৎ ক্লাইন্ট যেন বানানটা সহজে মনে রাখতে পারে।
• ভালো হোস্টিং প্রোভাইডারের কাছ থেকে হোস্টিং নিন। হোস্টিং প্রোভাইডার যদি আপনি নিজেও হন, এবং অনভিজ্ঞ হন, তাও ভালো অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠান থেকে হোস্টিং নিন, বেশি দাম হলেও।
• হোস্টিং প্রোভাইডার কে জিজ্ঞেস করবেন HTTP কে আপনারা নিজে HTTPS করে দেবেনতো? ওরা বুঝবে। রাজি না হলে অন্য প্রোভাইডার খুজবেন। কারণ আপনার সাইটে HTTPS না থাকলে গুগল ক্লাইন্টকে ঢুকতে নিরুৎসাহিত করতে পারে।
• ওয়েবসাইটে বেশি গর্জিয়াস করতে গিয়ে ভারি করে ফেলবেননা। PNG ছবির বদলে JPG ছবি ব্যবহার করুন। এতে ওয়েবসাইট হাল্কা থাকবে। খুব সহজেই ওয়েবসাইটে ঢোকা যাবে। বেশি ভারি হলে লোডিং এ সময় লাগবে, মানুষ ঢুকবেনা। বাউন্সরেট নামের একটা ক্ষতিকর দিক আছে, ঢোকার চেষ্টা করে না ঢুকলে ক্ষতিকর এই বাউন্সরেট বেড়ে যাবে।
• প্রয়োজনীয় তথ্য দিন, যাতে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। দারাজে অনেক বইয়ের শপে দেখবেন ডেস্ক্রিপশনে বইয়ের খুব প্রশংসা করে। কিন্তু আসল জিনিস বইয়ের কত পৃষ্ঠা সেটাই উল্লেখ করেনা। সেই বইয়ের গুরুত্ব আছে বলেইনা, সেই বইটায় ঢুকেছি, ওদের মুখ থেকে বইয়ের গুরুত্বের বর্ননা এখানে অতটা প্রয়োজনীয় নয়। আমার দরকার জানা কত পৃষ্ঠা, কোন কোয়ালিটির পৃষ্ঠা।

(সবশেষে)
আমরা অনেকেই দেখেছি, শহরের অলিতে-গলিতে, ঈদের আগে বাচ্চারা কাগজটাগজ সাজিয়ে ঈদকার্ডের দোকান বানায়, রাস্তার পাশে বসে। ওরা ঈদকার্ড বিক্রি করে। এত অল্প বয়সে ওরা ফিলিপ কার্টলার পড়েনি, সেথ গডিন পড়েনি। কপিরাইটিং কি তা-ই জানেনা। কিন্তু তারপরও ওরা বিক্রি করে, লোকজন আকৃষ্ট করে। বিক্রি প্রক্রিয়া যেন সহজ হয়, সেই চেষ্টাটাও করে।
আমরা ব্যবসা করি। মুলধন খাটাচ্ছি। ব্যবসা থেকে রুটিরুজি আসে, বাসাভাড়া দেই, কর্মীদের বেতন দেই, ওদেরও সংসার চলে।
ওই ছোটবাচ্চারা যেমন সিরিয়াস হয়, আমাদের তারচেয়েও সিরিয়াস হতেই হয়। তাই প্লিজ ঠান্ডা মাথায় ভাবুন কিভাবে আপনার বিক্রি সিস্টেম আরও সহজ করা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে অলস কাস্টমার আপনার কাছে এলে কিভাবে হাসিমুখে সেই অলস কাস্টমারের কাছে জিনিস বিক্রি করবেন, ভাবুন। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন।

অনেক ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। ব্যবসা সংক্রান্ত যেকোনো পরামর্শের জন্য পোস্ট করুন আমাদের বিক্রি বাড়ুক গ্রুপে। গ্রুপে অনেক অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী আছেন, আশাকরি তাদের পরামর্শ পথ খুজে পেতে সাহায্য করবে। আমাকে সরাসরি মেইলও করতে পারেন।

ভালো থাকবেন। সমৃদ্ধ হোক আপনার ভালোবাসার ব্যবসাটি।

তাজুল ইসলাম মাসুদ,

১০ ই জানুয়ারী, ২০২৩।
মঙ্গলবার।
tazulmasud007@gmail.com
Facebook
Twitter
Linkedin

Please share it

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *